সিলেট বিভাগ
আকর্ষণ সমূহ
তথ্য
বৃহত্তর সিলেট অথবা সিলেট অঞ্চল নামে পরিচিত সিলেট বিভাগ বাংলাদেশের উত্তরপূর্ব অংশে অবস্থিত। পুরাকীর্তির নিদর্শন সমৃদ্ধ সিলেটকে দক্ষিন এশিয়ার অন্যতম দর্শনীয় স্থান হিসেবে মনে করা হয়ে থাকে যেখানে রয়েছে বেশকিছু মুসলিম সুফি সাধকদের দরগা এবং হিন্দু ধর্মের বেশকিছু পবিত্র স্থান। কমলা, আনারস এবং চা বাগানে পরিপূর্ণ সিলেটকে আকর্ষণীয় করতে এখানকার অগ্রসরমান অর্থনীতির ভুমিকা অপরিসীম। সিলেট বিভাগের অনেকেই বিদেশে বিশেষ করে যুক্তরাজ্যে চাকরির সুবাদে বাস করে স্থায়ী হয়েছেন এবং বৈদেশিক মুদ্রা পাঠানোর মাধ্যমে এসব প্রবাসীসিলেট বিভাগের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প, শিল্প কারখানা, রপ্তানীবাণিজ্য এবং বৈদেশিক বিনিয়োগের প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রেখে চলেছেন। ইতিহাসবিদরা বিশ্বাস করেন প্রাচীনকাল থেকেই সিলেট ছিল একটি বর্ধিত বাণিজ্যিক কেন্দ্র যেটির সাথে সিলেটের নামকরনের যোগসূত্র রয়েছে। সেসময় সিলেটে আসামিজ, বাংলার দ্রাভিডিয়ান, আরব, পার্সিয়ান এবং তুর্কিরা ছাড়াও মূলত ইন্দো-আরিয়ান ভ্রামিন্সরা বসবাস করতেন। বলা হয়ে থাকে যে প্রাচীন হরিখেলা রাজ্য আধুনিক সিলেটে অবস্থিত ছিল। ১৪শ শতকে সিলেটে ইসলামের প্রভাব পরতে শুরু করে। মধ্যযুগীয় আমলে সিলেটে পার্সিয়ান ভাষায় কথা বলা মুসলিম মিশনারীজরা ব্যাপক সংখ্যায় বাস করত। ১৩০৩ সালে শাহজালাল নামে পরিচিত হযরত শাইখ আল মুশায়েখ জালালউদ্দিন নামক একজন মুসলিম সাধক মক্কা থেকে দিল্লি হয়ে ৩৬০ জন সুফি সাধক এবং সেনাপতিদের নিয়ে সিলেটে আসেন। তাঁর সাথে আসা সেনাপতিদের মধ্যে ছিলেন দিল্লির ফিরোজ শাহর ভাতিজা সিকান্দার গাজী, সৈয়দ নাসিরউদ্দিন এবং খাজা বুরহানউদ্দিন কুহাফান যারা গৌড়ের গোবিন্দকে যুদ্ধে পরাজিত করেছিলেন। সেসময় হযরত শাহজালাল ও তাঁর ৩৬০ জন আউলিয়ার আধ্যাত্মিক দর্শনে মুসলমানরা বেশীরভাগ হিন্দু, বৌদ্ধ এবং অন্যান্য ধর্মের বিশ্বাসীদের ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করে। ১৫শ শতাব্দীর মধ্যে সিলেট বাংলার মধ্যে প্রধান মুসলিম অঞ্চলে পরিনত হয়। ঐতিহাসিক কাগজপত্র ঘেঁটে জানা যায় যে মুসলিম শাসনামলে সিলেটকে জালালাবাদও বলা হত। হযরত শাহজালাল ১৩৫০ খ্রিস্টাব্দে ইন্তেকাল করেন। দরগা-ই-শাহজালাল মসজিদের অভ্যন্তরে তাঁর মাজার শরীফ অবস্থিত। হযরত শাহজালালকে আজও সম্মান করা হয়ে থাকে যে কারনে প্রতিবছর দেশ বিদেশ থেকে দর্শনার্থীরা তাঁর দরগায় এসে থাকেন। ইউরোপীয়ানরা পৃথিবীর প্রাচীনতম সভ্যতা ইন্দাস ভ্যালীর মানুষদের বিশ্বাস এবং রীতিনীতির নাম দিয়েছিল হিন্দুত্ব। সিলেট এবং বাংলাদেশের অন্যান্য অংশের মধ্যে সেই সভ্যতার প্রসিদ্ধ ইতিহাসের জটিল যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া যায়। কথায় আছে যে পৃথিবীতে পতিত হওয়া (দেবী দুর্গার আরেক রূপ) দেবী স্বতির একান্নটি দেহ খণ্ডের মধ্যে দুইটি এই সিলেটেই রয়েছে। দেবী স্বতির ঘাড় এবং বামহাতের তালু যথাক্রমে দক্ষিন সুরমাধীন গোটাটিকারের নিকটে জৈনপুর গ্রামের শ্রীসাইলে এবং জৈন্তিয়ার কালাজর বৌরভাগ গ্রামে পতিত হয়েছিল। এছাড়াও গোলাপগঞ্জ এবং হবিগঞ্জে রয়েছে ১৬শ শতাব্দীর কৃষ্ণ চৈত্তিন্নর পৈত্রিক নিবাস। ধারনা করা হয়ে যে কৃষ্ণ চৈত্তিন্নর বেশে পুনর্জন্ম লাভ করেছিলেন এবং পৃথিবীতে এসে মানবতাকে পথ দেখিয়েছিলেন। হিন্দুরা বিশ্বাস করেন যে কালীযুগে অথবা শেষ সময়ে চৈত্তিন্ন পৃথিবীতে আবারো আগমন করবেন। হিন্দুদের এই বিশ্বাসের সাথে খ্রিষ্টান এবং মুসলিমদের বিশ্বাসের মিল রয়েছে। মুসলিমরা এবং খ্রিষ্টানরা বিশ্বাস করেন শেষ দিবসে যথাক্রমে ইমাম মাহাদী এবং যীশু পৃথিবীতে আগমন করবেন। ১৮শ শতাব্দীতে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বার্মার বিরুদ্ধে যুদ্ধে সিলেটকে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ মনে করতে শুরু করে। ইংরেজরা ধীরে ধীরে সিলেটের নিয়ন্ত্রন গ্রহন করে এবং বাংলার অংশ হিসেবে সিলেটকে শাসন করে। ভারতে ইংরেজদের প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাসের পর আসামের অধীনে সিলেটকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ইংরেজ শাসনামলের অবশিষ্ট সময়ে সিলেট ছিল আসামের অংশ। ১৯৪৭ সালে গণভোট এবং দেশবিভাগের পর করিমগঞ্জ সাবডিভিশন ব্যাতিত সমগ্র সিলেট তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হয়ে যায় এবং করিমগঞ্জকে ভারতের নবগঠিত আসাম রাজ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ১৯৪৭ সালের ৩ জুলাই অনুষ্ঠিত হওয়া গণভোটে ২৩৯টি ভোটকেন্দ্রে সর্বমোট ৫,৪৬৮,১৫টি ভোট পড়ে এবং ৪৩.৮শতাংশ ভোটার পূর্ব বাংলার পক্ষে ভোট দেয়। গণভোটকে ঘিরে প্রতিবাদ করা হলেও ১৯৪৭ সালের ১৮ই জুলাই ভারতের স্বাধীনতা উদযাপনকালে এই গণভোটকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ১৯৭১ সালে সিলেটকে স্বাধীন বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। যুক্তরাজ্যের শহর সেইন্ট আলবান্সের সাথে সিলেটের রয়েছে বন্ধুত্বের যোগসূত্র। ১৯৮৮ সালে সিলেটে গৃহহীনদের জন্য একটি আবাসন প্রকল্পে সেইন্ট আলবান্স ডিসট্রিক্ট কাউন্সিল অর্থায়ন করলে এই বন্ধুত্ব স্থাপিত হয়। সেইন্ট আলবান্সের বৃহত্তম সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের আদি নিবাস সিলেটে হওয়ায় আবাসন প্রকল্পের জন্য সিলেটকে বেছে নেওয়া হয়েছিল। সেইন্ট আলবান্স ডিসট্রিক্ট কাউন্সিলের তথ্য অনুযায়ী বেশীরভাগ ইংরেজ বাংলাদেশির আদিবাস হল সিলেট যা কিনা পৃথিবীর অন্যান্য অংশের সাথে সিলেটের বাণিজ্যিক সম্পর্কেরই সাক্ষ্য বহন করে। অনেক সিলেটি নিজ নিজ অঞ্চল, সংস্কৃতি, সমাজ ও ধর্মের অনুগত মানুষকে বিবাহ করার চেষ্টা করেন। বাংলাদেশে সিলেটিদের পৃথক জাতিগোষ্ঠী হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। প্রথাগত মুসলমান সিলেটিরা পরিবার কেন্দ্রিক হয়ে থাকে এবং নিজেদের সংস্কৃতি মেনে চলার চেষ্টা করে। আর এই সাংস্কৃতিক বিভেদের কারনে সিলেটি এবং অসিলেটিদের মধ্যে মাঝে মাঝে বিরোধ দেখা যায়। সিলেটে মেহেদী উৎসব ও প্রার্থনা করাসহ ঐতিহ্যবাহী মুসলিম রীতিতে বিবাহ অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। কখনো কখনো একটি সিলেটি বিয়েতে বর ও কনের অধিকার ও বাধ্যবাধকতা লিপিবদ্ধ করে চুক্তিও করা হয়। সিলেটিরা প্রায়ই যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী নিজ জেলার মানুষদের বিয়ে করে থাকে। ইংরেজ রাজের শাসনকালে প্রায় ১০০শত বছর বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলটি ছিল আসাম এবং সুরমাভ্যালী রাজ্যের অংশ আর এ কারনেই সিলেটে গড়ে ওঠে নিজেদের সংস্কৃতি, অর্থনীতি এবং ভাষা। প্রবাসে বসবাসকারী সিলেটিরা এদেশে তাদের পরিবারকে প্রচুর পরিমানে বৈদেশিক মুদ্রা পাঠিয়ে থাকে।
Where to stay How to go